বায়রা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের বিরুদ্ধে ৬ হাজার ৬২৭জন গ্রাহকের পলিসির টাকা না দিয়ে প্রতারণা অভিযোগ উঠেছে। টাকা ফেরত পেতে প্রতিদিন শতশত গ্রাহক ভিড় করছে কোম্পানির প্রধান অফিসে; অভিযোগ দিচ্ছে নিয়ন্ত্রকসংস্থা আইডিআরএ । অথচ টাকা দেয়াতো দুরের কথা, আইন লংঘন করে কোম্পানির চেয়ারম্যান ও মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তারা দামী ‘লেক্সাস গাড়ি’ ব্যবহারসহ বিলাসবহুল জীবন যাপন করছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙ্গে প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে।
এ ব্যাপারে বীমাখাতের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান ইন্স্যুরেন্স ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেটরি অথরিটির (আইডিআরএ) পক্ষ থেকে কোম্পানিটিকে মঙ্গলবার প্রাথমিক নোটিশ দেয়া হয়েছে। ওই নোটিশে কেন পর্ষদ ভেঙ্গে দেয়া হবে না, তা ৭ কার্যদিবসের মধ্যে জানাতে বলা হয়েছে। নোটিশের জবাব এলেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
আইডিআরএ সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। এর আগে ২০১৮ সালে কোম্পাটিকে সাড়ে ৪ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছিল। ওই টাকাও পরিশোধ করেনি বায়রা।
জানতে চাইলে আইডিআরের সদস্য গকুল চাঁদ বলেন, কোম্পানিটির বিরুদ্ধে গ্রাহকের ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। এর আগে গ্রাহকের দাবি পূরণের জন্য আমরা কোম্পানির পর্ষদকে ডেকে ছিলাম। ওই সময়ে পর্ষদের পক্ষ থেকে ৩ মাস সময় নেয়া হয়েছে। এই তিন মাসের মধ্যে তারা দাবি পরিশোধের কথা বলেছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে কাঙ্খিত অগ্রগতি না হওয়ায় এ পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছি। তিনি বলেন, বীমাখাতে বড় সমস্যা মানুষের আস্থা সংকট। এই সংকট দুর করতে গ্রাহকের স্বার্থ রক্ষায় কঠিন পদক্ষেপ আইডিআরএ।
সূত্র জানায়, কোম্পানিটির পর্ষদ ভেঙ্গে দেয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। কিন্তু নোটিশ দিয়ে সময় না দিলে তারা উচ্চ আদালতে রিট করতে পারে। এছাড়াও আরও ৪টি কোম্পানির বিরুদ্ধে একই ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বর্তমানে ১২ সদস্য বিশিষ্ট বায়রা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের পর্ষদে চেয়ারম্যান হিসাবে রয়েছেন মোহাম্মদ আবুল বাশার, ভাইস চেয়ারম্যান মো. ফরিদ আহমেদ, পরিচালক মো. মফিজুর রহমান চৌধুরী, ফজলে আকবর চৌধরী, মীর মোহাম্মদ মারফাত উল্লাহ, মো. মনসুর আহমেদ কালাম, মো. আবুল বারাকাত ভুইয়া, মো. অনীক ইনতেসার আহমেদ, মোহাম্মদ মাহমুদুল হক, নাসির উদ্দিন ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ওমর ফারুক ভুইয়া। এছাড়াও স্বতন্ত্র পরিচালক হিসাবে রয়েছেন আশরাফ উদ্দিন এবং আজিজুল হক দুলাল।
জানা গেছে- গ্রাহকের বিভিন্ন অভিযোগের পর আইডিআরএ’র পক্ষ থেকে কোম্পানিটি কার্যক্রম কয়েক দফা তদন্ত করা হয়। এক্ষেত্রে শুধু নোয়াখালী দত্তের হাট সার্ভিসিং সেল শাখায় তদন্ত করেই ৮৬১জন গ্রাহকের টাকা না দেয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। মেয়াদ শেষ হলেও ওইসব গ্রাহক বছরের পর বছর কোম্পানির অফিসে ধর্না দিচ্ছে। ফলে ওই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে পুরো বীমা শিল্পের ব্যাপারে নেতিবাচক ধারনা তৈরি হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পলিসির টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য প্রতিদিনই আইডিআরের কর্মকর্তাদের রুমের সামনে গ্রাহকের লাইন থাকে। বছরের পর বছর কোম্পানির কাছে ধর্ণা দিয়ে শেষ পর্যন্ত আসছে আইডিআরের কাছে। হঠাৎ করে নিয়ন্ত্রকসংস্থার অফিসে কেউ গেলে মনে হবে রমজানে যাকাতের টাকা বিতরণ হচ্ছে। এভাবেই গ্রাহকরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছে। এসব গ্রাহকের কান্নার আওয়াজ অন্য কর্মকর্তাদের রুম থেকেও শোনা যাচ্ছে। ফলে এ ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে আইডিআরএ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আইডিআরের একজন সদস্য বলেন, সহজ সরল এসব মানুষগুলোর কান্না সহ্য করা যায় না। ফলে আইনে যতটুকু ক্ষমতা দেয়া আছে, তার সর্বোচ্চ ব্যবহার করা হবে। কোনোভাবেই প্রতারক কোম্পানি ছাড় পাবে না।
আইডিআরএ সূত্র জানায়, ২০১৮ সাল পর্যন্ত কোম্পানিটির বিরুদ্ধে তাদের কাছে মোট ৮ হাজার ২৩৭জন গ্রাহক অভিযোগ করেছেন। এ নিয়ে কোম্পানিকে ১৩টি চিঠি দেয়াসহ ২টি শুনানী অনুষ্ঠিত হয়। তবে কোম্পানির পক্ষ থেকে জানানো হয়, তারা ১ হাজার ৬১০জন গ্রাহকের টাকা পরিশোধ করেছে। এরপরও ৬ হাজার ৬২৭জন গ্রাহকের টাকা পরিশোধ হয়নি।
বায়রা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের কাছে দেয়া আইডিআরের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের অদক্ষ ব্যবস্থাপনায় বীমা গ্রাহকদের স্বার্থ সংরক্ষণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। একই সঙ্গে তারা এখাতে তীব্র ইমেজ সংকট তৈরি করছে। কোম্পানিটি ২০১০ সালের বীমা আইনের বিভিন্ন ধারা লংঘন করে কোম্পানিটিকে একটি অকার্যকর বীমা প্রতিষ্ঠানে পরিনত করেছে। এ কারণে বীমা আইনের ৯৫ ধারা মোতাবেক কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের কার্যক্রম সাময়িকভাবে স্থগিত করে কেন প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হবে না তা ৭ কার্যদিবসের মধ্যে জানাতে হবে।
আইডিআরএ সূত্র জানায়, আইন লংঘন করে কোম্পানির অতিরিক্ত ব্যয়, নির্ধারিত সময়ে পুঁজিবাজারে না আসা এবং আইন অনুসারে কোম্পানির পরিচালকদের ২ শতাংশ শেয়ার নেই। ফলে পুরো বীমাখাতে একটি কঠোর বার্তা দিতে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে।
পাঠকের মতামত: